আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি ) সুন্দরবন দিবস। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে যখন এই দিনটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে, তখন সুন্দরবন সন্নিহিত ৫টি জেলার মানুষ সুন্দরবন সুরক্ষার আহবান জানিয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ভালোবাসা দিবসকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সন্তানের মতো উপকূলের কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদ রাখলেও সুন্দরবন এখন নিজেই ভালো নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ সহ ম্যানগ্রোভ এই বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী চোরা শিকারী ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব সংকটে।
তবে, বনবিভাগ বলছে তারা অধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্রেট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার তার প্রাকৃতিক রূপ বদলানো সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই এখন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ( বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা)। বঙ্গেপসাগরের পানিতে দিনে দুবার প্লাবিত এই বনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে জলাভূমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই জলাভূমি ‘রামসার’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য অধিকতর সমৃদ্ধ। সুন্দরীসহ এই বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। বাঘ, হরিণ, কুমির, কিং কোবারা, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২১০ প্রজাতির মাৎস্য। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রকৃতিক দূর্যোগে যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে সন্তানের মতো উপকূলের কোটি-কোটি
মানুষকে নিরাপদ রাখে তেমনি এই জনপদের লাখ-লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবেও কাজ করে।
সুন্দরবন এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানার শিল্পবর্জ্যে এই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বনের প্রাণপ্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে।
লোকালয় সন্নিহিত সুন্দরবন এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় চোরা শিকারীদের হাতে মারা পড়ছে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণী। সুন্দরবনে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১৭টি। চোরা শিকারীরা অধিক মুনাফার আশায় বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাঁত, নখ পাঁচার নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শ্রেণীর জেলে খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে হুমকির মুখে ফেলেছে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনেরে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে সুন্দরবনে। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রাকৃতিক দূযোর্গ ছাড়াও পূর্ণিমা ও অমাবশ্যার জোয়ারে সুন্দরবনের সব থেকে উঁচু এলাকা করমরজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রেও ২ থেতে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর ডিম। এতে করে কুমিরসহ যেসব বন্যপ্রাণী ডিম থেকে বাচ্ছা ফুটিয়ে বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলারদার আজাদ কবির।
বন বিভাগ আরো জানায়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে বাঘ ছাড়া হরিণসহ সব বন্যপ্রাণীর আর কোনো জরিপ না হওয়ায়
খোদ বন বিভাগও অন্ধকারে রয়েছে কোন প্রজাতির কতোটি বন্যপ্রাণী রয়েছে। তবে ২০১৮ সালে সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ টিতে। এই অবস্থার করোনা মহামারির মধ্যেও সুন্দরবনের আশেপাশের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার মানুষ আজ ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করবে।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের উপর পর্যটকদের চাপ কমানোসহ ইসিএভূক্ত এলাকায় নতুন করে শিল্পকলকারাখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এই ম্যানগ্রোভ বনে লোকবলসহ নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনের উপর নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ কঠোর চোরা শিকারী, কাঠ পাচারকারী ও বনে আগুন দিয়ে সম্পদ লুটকারীরা দমন করতে পারলেই রক্ষা পাবে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি।
এত সংকটের মধ্যেও আশার কথা জানিয়ে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ( ডিএফও ) বলেছেন, অধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্রেট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় চেষ্টার পাশাপাশি ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হলে দ্রতই সুন্দরবনের সব বন্যপ্রাণীর জরিপ শুরু হবে। আগামী জুন মাসের মধ্যে ৮৪টি পুকুর খননও পুনঃখননের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর সুপেয়ে পানির চাহিদা মেটাবে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে। এত করে সুন্দরবন অনেক সুরক্ষিত হবে।